অর্থায়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করে, কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হলে কারবারে সর্বোচ্চ মুনাফা হবে, অর্থায়ন সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মালামাল বিক্রয় থেকে অর্থের আগমন হয়। কারবারে মালামাল প্রস্তুত ও ক্রয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের তহবিলের প্রয়োজন হয়। যেমন: মেশিনপত্র ক্রয়, কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকদের মজুরি প্রদান ইত্যাদি। এগুলো তহবিলের ব্যবহার। তহবিলের এই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক তহবিল সংগ্রহ করতে হয়, যেন উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবহার-সংক্রান্ত এই প্রক্রিয়াকে বুঝায় ।
তোমার এলাকার কোনো দর্জির দোকানে গেলে দেখতে পাবে, একজন বা দুজন সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছে। আবার হয়তো কেউ কাপড় কাটছে বা বোতাম সেলাই করছে। ফলে একটি দর্জির দোকানের মালিককে তার এই কার্যপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য সেলাই মেশিন ক্রয়, সুতা, বোতাম, কাঁচি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পরিমাণে ক্রয় করতে হয়। ব্যবসার শুরুতে সাধারণত এসব ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সে তার নিজস্ব মূলধন ব্যবহার করে নির্বাহ করে। ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিলের ঘাটতি হলে নিজস্ব মূলধনের সাথে কিছু পরিমাণ অর্থ আত্মীয়স্বজন থেকেও ঋণ নিতে পারে। ব্যবসায় চলাকালীন অবস্থায় মাসের শেষে কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য যে ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হয়, সেটি সে কাপড় সেলাই থেকে অর্জিত আয় হতে পরিশোধ করে। এই আয় থেকে তাকে ঋণের অর্থ পরিশোধেরও পরিকল্পনা করতে হয়। একজন দর্জি দোকানের মালিকের সব সময় প্রত্যাশা থাকে, যেন ব্যবসার আয় থেকে ব্যবসায়ের ব্যয় নির্বাহের পরও কিছু মুনাফা থাকে, যা দিয়ে সে নিজের পরিবারের নৈমিত্তিক খরচ মিটিয়েও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারে কিংবা ব্যবসায় সম্প্রসারণে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং একজন দর্জি দোকানের মালিক যদি তহবিলের উৎস ব্যবহার সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনা করে, তবেই সে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে মুনাফা অর্জন করতে পারবে। অন্যথায় দেখা যাবে, কাপড় সেলাই করতে সুতা প্রয়োজন কিন্তু নগদ অর্থ নেই বলে খরিদ্দার ফেরত যাচ্ছে। অথবা পুরাতন মেশিনটি পরিবর্তন করে নতুন মেশিন ক্রয় করার তহবিল নেই বলে ব্যবসাটি বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। ব্যবসায় অর্থায়নে বা ফিন্যান্সে ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কখন, কী কারণে, কত তহবিল প্রয়োজন এবং কোথা থেকে সেই তহবিল সরবরাহ করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
পরিবারেও অর্থায়নের প্রয়োগ আছে। সাধারণত প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক আয়ের উৎস থাকে। চাকুরি, ব্যবসায়, কৃষিকাজ, আত্মউদ্যোগ ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবারভেদে আয়ের সংস্থান হতে পারে। আবার দৈনন্দিন বাজার খরচ, বাড়ি ভাড়া, স্কুলের বেতন, বিভিন্ন বিল প্রদান ইত্যাদি খাতে পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় সংঘটিত হয়। আয়ের সাথে যেমন ব্যয়ের সংগতি রাখা প্রয়োজন, তেমনি ব্যয়ের সঠিক সময়ের দিকটাও সংগতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। যখন যে পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন, তখন সে পরিমাণ অর্থ না থাকলে
হয়তো স্কুলের বেতন বকেয়া হয়ে যাবে, ফলে স্কুল থেকে নাম কাটাও যেতে পারে। পূর্বপরিকল্পনামাফিক এই তহবিলের উৎস নির্ধারণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারই পরিবারের ক্ষেত্রে অর্থায়ন প্রক্রিয়া। নিত্যনৈমিত্তিক এই ধরনের প্রয়োজন ছাড়াও মাঝেমধ্যে পরিবারকে তার আয়ের বাইরেও বড় অংকের ব্যয় করতে হতে পারে। বাসায় নতুন টেলিভিশন কিংবা রেফ্রিজারেটর ক্রয়ের জন্য যদি আয়ের নিয়মিত উৎস থেকে অর্থ সরবরাহ করা সম্ভব না হয়, তখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঋণ ফেরত দেওয়ার একটি পরিকল্পনা করা প্রয়োজন হয়। ফলে পরিবারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য পরিকল্পনামাফিক তহবিলের উৎস নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা করতে অর্থায়নের ধারণা সহায়তা করে।
একটি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অর্থায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিচিত হওয়া যায়। বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়, সেখানেও আয়-ব্যয় ও তহবিল ব্যবস্থাপনার একটি পরিকল্পনা থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফি, এসব উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করে। সুষ্ঠুভাবে ক্লাস পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে এই তহবিল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। যেমন: শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, ঘরভাড়া প্রদান, বিদ্যুৎ বিল প্রদান, বিভিন্ন প্রকার সংস্কারমূলক ব্যয়, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ক্রয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বহুবিধ কার্যপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তহবিলের বিভিন্ন উৎস ও ব্যবহারের বিবিধ খাত বিবেচনা করে যথাযথভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা বিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে অর্থায়ন। উপরের উদাহরণগুলোর মধ্যে দর্জির দোকান একটি মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান, কিন্তু পরিবার ও বিদ্যালয় মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান নয় বর্তমান পাঠ মূলত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা বা কারবারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন নিয়ে জড়িত। একজন মুদি দোকানির অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি কেমন? মুদি দোকানি পণ্য বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে। আবার পণ্য বিক্রয়ের জন্য তাকে পণ্য ক্রয়, দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন ইত্যাদি চলতি খরচ, যা নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে হয়। আবার কখনো কখনো ক্রেতার প্রয়োজনে তাকে দোকানের আয়তন বৃদ্ধি, রেফ্রিজারেটর ক্রয় ইত্যাদি বড় আকারের খরচ করতে হয়। এগুলো তার স্থায়ী খরচ। ফলে মুদি দোকানি সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য চলতি ও স্থায়ী সম্পদে তহবিল বিনিয়োগ করে। বিক্রয়লব্ধ আয় হতে যদি বিনিয়োগের তহবিল সংস্থান করা না যায়, তবে তাকে বিভিন্ন উৎস যেমন: নিজস্ব তহবিল, বন্ধুবান্ধব, ধারে পণ্য ক্রয় ইত্যাদি থেকে তহবিল জোগাড় করতে হয়। আবার স্থায়ী সম্পদ অর্জনের জন্য যে বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটি সাধারণত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গ্রহণ করতে পারে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ পরিশোধের সুযোগ থাকায় ঋণ পরিশোধের ঝুঁকি কিছুটা কমে যায়। মুদি ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে বিক্রয়লব্ধ অর্থের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে চলতি ব্যয় নির্বাহ, কিছু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কম ঝুঁকিপূর্ণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে, সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তির পরিশোধ সম্পর্কিত তহবিল ব্যবস্থাপনা কারবারি অর্থায়নের মূল কাজ।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বাটা কোম্পানি, কোহিনূর কেমিক্যালস এগুলো বড় পরিসরের কারবারি প্রতিষ্ঠানকে বল হয় কোম্পানি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন প্রক্রিয়া মুদি দোকান বা দর্জির দোকানের মতো সরল নয়, বরং অপেক্ষাকৃত জটিল। একটি কোম্পানি অর্থ বা তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন কোম্পানি তার প্রয়োজনীয় তহবিল মূলত শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম, মুনাফার হার, গ্রাহকসেবা বা ভোক্তা সন্তুষ্টি শেয়ারবাজারে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বিভিন্ন উৎসের মধ্যে কোন উৎস, কখন, কী পরিমাণে ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহ করা উচিত এবং কোন কোন খাতে কী পরিমাণে তা কীভাবে খরচ বা বিনিয়োগ করে মুনাফা বৃদ্ধি করা যায়, কারবারি অর্থায়ন তা নিয়ে আলোচনা করে এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।
Read more